সম্পাদকীয়|Editorial
DOI:
https://doi.org/10.58666/iab.v21i82-83.333Abstract
সম্পাদকীয়
আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে ইসলামী আইন ও বিচার জার্নালের ৮২ ও ৮৩ তম যৌথ সংখ্যা প্রকাশিত হলো। এবারের সংখ্যায় সমসাময়িক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে চারটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
শুরুতেই রয়েছে “মুসলিম বিচারশাসনে মাজালিম আদালতের (ন্যায়পাল) ধারণা ও প্রয়োগ: একটি ঐতিহাসিক অনুসন্ধান” শীর্ষক প্রবন্ধ। কোনো জাতি বা জনগোষ্ঠী সভ্যতার মানদণ্ডে কতটা অগ্রসর, তা মূল্যায়নের সর্বোত্তম উপায় হলো— সেখানে ন্যায়বিচার কতটা কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে তা পরিমাপ করা। ইসলামী সভ্যতার মৌলিক ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে ন্যায়বিচারের উপর। হাজার বছরের মুসলিম সভ্যতার ইতিহাসে মাজালিম আদালত ছিল এমন এক অনন্য প্রতিষ্ঠান, যেখানে দুর্বলের প্রতি শক্তিমানের অন্যায় ও জুলুমকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিহত করা হতো। প্রবন্ধে এই অনন্য বিচারব্যবস্থার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বাস্তব প্রয়োগের বিবরণ উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে যে, আধুনিক ওম্বুডসম্যান বা ন্যায়পাল ধারণার সাথে অনেকাংশে মিল রাখা এই বিচারিক ব্যবস্থাকে মুসলিম শাসকেরা যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে নিয়েছিলেন। স্থান-কালের পরিক্রমায় এর কাঠামোগত ভিন্নতা থাকলেও উদ্দেশ্যগত দিক থেকে এটি সব সময় একই আদর্শে অবিচল থেকেছে—শাসনক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করা এবং জনগণের প্রতি প্রশাসনের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা। মাজালিম আদালতের মূল লক্ষ্য ছিল শাসক বা প্রশাসনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, যা ইসলামী ন্যায়বিচারের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। এই প্রবন্ধে সেই ঐতিহাসিক ব্যবস্থার কার্যপ্রণালি ও প্রশাসনিক দায়বদ্ধতার বহুমুখী বিশ্লেষণের মাধ্যমে মুসলিম শাসনব্যবস্থায় ন্যায়পাল ধারণার মৌলিক রূপটি উন্মোচন করা হয়েছে।
“ভূমিদূষণ প্রতিরোধে বাংলাদেশী আইন ও ইসলামী নির্দেশনা” শীর্ষক প্রবন্ধে গবেষক বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান ভূমিদূষণ সংকটকে কেন্দ্র করে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন—বিদ্যমান আইনগত কাঠামো কতটা কার্যকর এবং ইসলামী নির্দেশনা এতে কী ধরনের পরিপূরক ভূমিকা রাখতে পারে। প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আইনসমূহে ভূমিদূষণ প্রতিরোধে একাধিক প্রতিকারমূলক ও শাস্তিমূলক বিধান বিদ্যমান। তবে এসব আইনের বাস্তব প্রয়োগ ও শাস্তিমূলক ধারাগুলোর কার্যকারিতায় রয়েছে নানা ঘাটতি। লেখক এখানে ইসলামী নির্দেশনার আলোকে এই দুর্বলতাগুলো বিশ্লেষণ করেছেন এবং দেখিয়েছেন যে, ইসলামে পরিবেশ সংরক্ষণ কেবল একটি সামাজিক দায়িত্ব নয়, বরং এটি একটি ধর্মীয় কর্তব্য। লেখক আরো দেখিয়েছেন যে, ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ভূমিদূষণ প্রতিরোধের লক্ষ্য শুধুমাত্র শাস্তি নয়, বরং মানুষকে পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল করে তোলাই মূল উদ্দেশ্য। অন্যদিকে বাংলাদেশের আইনগত কাঠামো সেই নৈতিক চেতনার ঘাটতি পূরণ করতে সক্ষম নয়। তাই উভয়ের সমন্বিত প্রয়োগই হতে পারে একটি কার্যকর ও ন্যায়ভিত্তিক সমাধান। আধুনিক শিল্পায়ন, নগর সম্প্রসারণ ও কৃষিতে রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশের ভূমি দ্রুত দূষিত হচ্ছে; এর প্রভাব পড়ছে কৃষি উৎপাদন, জনস্বাস্থ্য এবং জীববৈচিত্রের ওপর। এই বাস্তবতায় প্রবন্ধটি কেবল একটি পরিবেশগত গবেষণা নয়, বরং নৈতিক ও আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে টেকসই সমাধান খোঁজার গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা।
বাংলাদেশের মানুষের জন্য জুলাই বিপ্লব, ২০২৪ এক অবারিত সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। রাষ্ট্রসংস্কারের নানা দিক পুনর্বিবেচনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। “আল-কুরআনে প্রদত্ত নারীর অর্থনৈতিক অধিকার ও নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন: একটি পর্যালোচনা” শীর্ষক প্রবন্ধে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন সম্পর্কে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পশ্চিমা সভ্যতার আধিপত্যশীল বয়ানে নারীর অর্থনৈতিক অধিকার নতুন ইস্যু হলেও আল-কুরআন চৌদ্দশত বছর পূর্বেই এ ব্যাপারে যে সুস্পষ্ট নীতিমালা ও বিধিবিধান নির্ধারণ করেছে, তা কালোর্ত্তীণ এবং ন্যায়ভিত্তিক স্থায়ী সমাধানের দৃষ্টান্ত। তবে উদ্বেগের বিষয় এই যে, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে উপস্থাপিত কিছু সুপারিশে আল-কুরআনের এই ন্যায্য ও ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষত উত্তরাধিকারে সমান অংশ প্রদান, অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রবর্তন এবং যৌনকর্মীদের পেশাগত স্বীকৃতি প্রদান—এমন কিছু প্রস্তাব ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে শুধু বিতর্কিতই নয়, বরং সমাজের নৈতিক ও পারিবারিক কাঠামোর ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। নারী অধিকার প্রশ্নে প্রয়োজন গভীর গবেষণা, আন্তরিক সংলাপ, এবং ধর্মীয় জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিভঙ্গি—যাতে ন্যায়সঙ্গত ভাবে নারীর অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়। প্রবন্ধ পাঠের মাধ্যমে পাঠক বুঝতে পারবেন যে, নারীর অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় আল-কুরআনই সর্বাধিক ভারসাম্যপূর্ণ ও টেকসই দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে, আর আধুনিক সংস্কার প্রচেষ্টাগুলো তখনই ফলপ্রসূ হতে পারে যখন সেগুলো এই দিকনির্দেশনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে প্রয়োগ করা হবে।
“বদর যুদ্ধে বন্দীদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ স. এর ফয়সালা: একটি ঐতিহাসিক ও নৈতিক পর্যালোচনা” শীর্ষক প্রবন্ধে প্রবন্ধকার দেখিয়েছেন যে, মানব সভ্যতার ইতিহাসে বদর যুদ্ধ শুধুমাত্র একটি সামরিক বিজয় নয়; বরং এটি আল্লাহর রাসূল স. এর নৈতিক নেতৃত্ব, মানবিক মূল্যবোধ এবং যুদ্ধনীতির আদর্শিক উৎকর্ষের এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। আধুনিক যুগের জেনেভা কনভেনশনের হাজার বছর আগেই ইসলামী যুদ্ধনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মানবমর্যাদা রক্ষার সুউচ্চ আদর্শ। প্রবন্ধ পাঠের মাধ্যমে পাঠক উপলব্ধি করবেন যে, রাসূলুল্লাহস. এর যুদ্ধনীতিতে রয়েছে মানবজাতির জন্য সর্বজনীন ন্যায়বোধ ও মানবিকতার চিরন্তন আহ্বান।
“আল-কুরআনের আলোকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: একটি পর্যালোচনা” শীর্ষক প্রবন্ধে গবেষক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রচলিত ধারণাকে নতুনভাবে বিশ্লেষণ করেছেন— যেখানে অর্থনীতি কেবল বস্তুগত সমৃদ্ধি বা উৎপাদন বৃদ্ধির পরিসংখ্যান নয়, বরং নৈতিকতা, ন্যায়বিচার, ও মানবকল্যাণের এক পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি। আধুনিক অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি পরিমাপ করা হয় জিডিপি, মাথাপিছু আয় কিংবা বিনিয়োগের হার দ্বারা; কিন্তু এই কাঠামোতে নৈতিকতা, আত্মিক শুদ্ধি এবং সম্পদের ন্যায্য বণ্টনের প্রশ্ন প্রায়ই উপেক্ষিত হয়। প্রবন্ধে লেখক দেখিয়েছেন, আল-কুরআনের আলোকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া, যা একদিকে বস্তুগত অগ্রগতি নিশ্চিত করে, অন্যদিকে সামাজিক ভারসাম্য ও আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির ভিত্তিও সুদৃঢ় করে। প্রবন্ধে আল-কুরআনে বাণিজ্য চুক্তি, প্রাকৃতিক সম্পদের ন্যায্য ব্যবহার, পরিবেশ সংরক্ষণ, সুষম ব্যয়নীতি, উত্তরাধিকার বণ্টন এবং উৎপাদনের প্রতি ইতিবাচক মনোভাবের পাশাপাশি তাকওয়া, তাওয়াক্কুল, ইস্তিগফার ও নেক আমলের মতো আধ্যাত্মিক গুণাবলিকে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার নৈতিক ভিত্তি হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আজকের বিশ্বে যেখানে ধনসম্পদ সীমিত শ্রেণির হাতে কেন্দ্রীভূত, সেখানে কুরআনের ইনসাফ, ইনফাক, পরিমিত ব্যয় এবং পারিবারিক স্থিতিশীলতার নীতিগুলো অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও টেকসই উন্নয়নের বাস্তব দিকনির্দেশনা দিতে পারে। এই প্রবন্ধের মাধ্যমে পাঠক বুঝতে পারবেন যে, আল-কুরআনের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এমন বাস্তবধর্মী কাঠামো, যা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র—তিন স্তরেই ন্যায়ভিত্তিক, ভারসাম্যপূর্ণ এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথ নির্দেশ করে।
ইসলামী আইন ও বিচার জার্নালের ৮২ ও ৮৩ তম যৌথ সংখ্যায় অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি প্রবন্ধই সমকালীন ইসলামী চিন্তাধারা ও প্রাসঙ্গিক বিষয়সমূহকে যথাযথভাবে প্রতিফলিত করেছে। প্রবন্ধগুলোতে আধুনিক সময়ের ইসলামী গবেষণার নানা দিক উন্মোচিত হয়েছে, যা পাঠকদের জ্ঞানবৃদ্ধি ও অনুপ্রেরণায় নতুন মাত্রা যোগ করবে। আশা করা যায়, এই সংখ্যার প্রবন্ধসমূহ পাঠকদের চিন্তাকে সমৃদ্ধ করবে এবং বরাবরের মতই আদৃত হবে।
- প্রধান সম্পাদক
Published
Issue
Section
License
Copyright (c) 2025 Abu Bakr Rafique Ahmad

This work is licensed under a Creative Commons Attribution 4.0 International License.



